adsera ad

Thursday, July 9, 2020

সরল অঙ্কে খুন রহস্য

বাড়ির উঠোনের এক কোনায় ছোট্ট টয়লেট। টিনের তৈরি। জং ধরে চালে ছোট ছোট ছিদ্র হয়ে গেছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তা টয়লেটে। প্রাকৃতিক ডাকে বড় কাজ সাড়ছেন। টয়লেটেই নাকি জগতের ঋষি মহাঋষিরা সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তাও খুন রহস্যের সমাধান নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু কেমনে কী করবেন? তার মাথায় কোনো কিছুই খেলছে না। চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা দুই শিশু খুনের মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। পেরিয়ে গেছে ছয়/সাত মাস। আগের তদন্ত কর্মকর্তা তেমন কিছুই খুঁজে পাননি। নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তার মাথা ঘুরছে। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, দিনদুপুরে ডাকাতির ঘটনা কীভাবে ঘটল? ডাকাতদল কোনো কিছু লুট করল না, কিন্তু বাসার গৃহকর্ত্রীকে হাত পা বেঁধে রেখে দুটি স্কুল পড়ুয়া শিশু সন্তানকে হত্যা করে চলে গেল? তাদের মাকেও কিছু করল না। তাহলে কি এটি ডাকাতির ঘটনা নয়? কোনো ঘটনা ঘটলেই পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সাধারণ একটা বিষয় থাকে-সন্দেহের বাইরে কেউ নয়। এই পুলিশ কর্মকর্তাও সেই সন্দেহের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য কাউকে সন্দেহের মধ্যে নিতেও পারছেন না। এমন সব ভাবনার মধ্যে কর্মকর্তার চোখ ঘুরছে টয়লেটের চারপাশে। মাথা উঁচু করে চালের দিকে তাকাচ্ছেন। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় একটি কাগজের দিকে। টিনের চালে একটা ভাঁজ করা কাগজ আটকে আছে। দীর্ঘদিন ধরে রোদে পুড়ে লালচে হয়ে আছে। দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। তিনি কাজকর্ম সেরে দাঁড়িয়ে ভাঁজ করা কাগজটি হাতে নেন। কাগজটি খুলেই দেখেন স্থানীয় একটি স্কুলের নাম। নিচে ১৪টি সরল অঙ্কের প্রশ্ন। পুরোটাই হাতে লেখা। হয়তো স্কুলের পরীক্ষার জন্য প্রশ্নটি তৈরি করা হয়েছিল। নিহত দুই শিশুর বাবাও একই স্কুলের শিক্ষক। তবে তাদের বাসার টয়লেটে কেন এই প্রশ্নপত্র পাওয়া যাবে! গোয়েন্দা কর্মকর্তার ধারণা, এটি তার হাতের লেখাও হতে পারে। কিন্তু কর্মকর্তাটি তার সন্দেহের তালিকায় একজনকেই রাখতে চাচ্ছেন না। তিনি তার এক পদস্থ কর্মকর্তার কথা ভাবছেন। তিনি একসময় বলেছিলেন, দৃশ্যমান কিছুই যখন পাওয়া যাবে না, বড় কোনো তথ্য প্রমাণ মিলবে না-তখন ছোটখাটো বিষয়ের দিকেই নজর দিতে হবে। এই কর্মকর্তাটি তার সেই পদস্থ কর্মকর্তার কথাটি মেনে এগোনোর চিন্তা করলেন। হতেও পারে এই প্রশ্নপত্রটি খুনের কোনো বড় সূত্র! সরল অঙ্কের প্রশ্নপত্র নিয়েই খুনের তদন্তে এগিয়ে যান তিনি। কিন্তু বেশি দূর যেতে হয়নি তার। মেধা আর বিচক্ষণতায় তার সেই ধারণাই সত্য প্রমাণিত হয়। সরল অঙ্কের সেই প্রশ্নপত্রই খুলে দেয় খুনের জটিল রহস্য। খুনি ধরা পড়ে। অকপটে সব স্বীকার করে। ফাঁস করে খুনের নেপথ্যে থাকা এক নিষিদ্ধ প্রেম কাহিনী। গ্রেফতার করা হয় দুই শিশুর মাকেও।

রাজধানীর মিরপুরের ঘটনা এটি। ১৯৯৮ সালে দিন দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই খুনের স্বীকার হয় দুই ভাই। দুজনকেই শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। খুনের ঘটনাটি ডাকাতি বলেই প্রচার করা হয়। ডাকাত ডাকাত চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন ওই বাসায় যায়, তখন তারা দেখতে পান স্কুল শিক্ষকের তরুণী স্ত্রীর হাত পা বাঁধা। মুখে কাপড় গোঁজা। ডাইনিং রুমে পড়ে আছে। খাটে এবং ফ্লোরে পড়ে আছে তাদের ৬ ও ৮ বছরের দুই শিশু সন্তান। ডাকাত দল কোথা দিয়ে আসল, কোথা দিয়ে পালাল-কেউ তখন বলতে পারেনি। তবে সবাই বিশ্বাস করেই নিয়েছে যে, ডাকাতির ঘটনাই হয়তো ঘটেছে। মামলার তদন্ত সেই পথেই গিয়েছে। দুই শিশু হত্যা এবং মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে খুনের নানা বাঁকের কথা। এ ঘটনায় স্কুল ও স্কুলশিক্ষকের মতো স্পর্শকাতর কিছু বিষয় জড়িত থাকায় নাম পরিচয় গোপন রেখেই প্রতিবেদন তৈরি করা হলো।

মিরপুরে চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনার পর সারা দেশে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। তদন্তে তেমন কিছু বেরিয়ে না আসায় ধীরে ধীরে ঘটনাটি আড়াল হতে থাকে। কিন্তু মামলার তদন্তে নতুন একজন এসআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার পর পুরো ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। পুলিশের ওই কর্মকর্তা সরল অঙ্কের সেই প্রশ্নপত্রটি নিয়ে এগিয়ে যান। তিনি স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করেন খেলার মাঠে যেয়ে। ওই স্কুলেই পড়ত ওই দুই শিশু। দুই শিশুর বাবা ফজলুল হক (ছদ্মনাম) একই স্কুলের শিক্ষক। পুলিশের কর্মকর্তা স্কুলের ছাত্রদের প্রশ্নপত্রটি দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা আনোয়ার স্যারের (ছদ্মনাম) নাম বলে। আনোয়ার স্যারের হাতের লেখা তারা চিনে এবং তাদের ক্লাস টিচারও। বড় ধরনের ক্লু পেয়ে গেছেন বলে ভাবতে থাকেন পুলিশের কর্মকর্তা। তিনি সেদিনই সেই আনোয়ার স্যারের কাছে যান। নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, পুলিশের এক কর্মকর্তাকে ফেয়ারওয়েল দিতে হবে। লেখা প্রয়োজন। হাতের লেখা সুন্দর বলে তাকেই সেই লেখাটি লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানান। অল্প বয়সের আনোয়ার স্যার তাতে রাজি হন। খুশি মনেই পুলিশ কর্মকর্তার সামনে লিকতে থাকেন। এক পর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাটি তার পকেট থেকে প্রশ্নপত্রটি বের করেন। আনোয়ার স্যারকে দেখিয়ে বলেন, ‘দেখেন তো এই লেখাটি আপনার কিনা’। প্রশ্নপত্রটি দেখেই ঘাবড়ে যান আনোয়ার স্যার। স্বীকার করেন তিনি। তার মনের ভিতর ভয় কাজ শুরু করে। পুলিশ কর্মকর্তাকে জানায়, তার শরীর ভালো লাগছে না। পুলিশ কর্মকর্তা তাকে রেস্টে রেখে সেদিনের মতো চলে যান। আনোয়ার স্যার ভাবতে থাকেন, সব জেনে গেল কিনা। তাহলে বিরাট সমস্যা হবে। পরিকল্পনা করে টাকা দিয়ে পুলিশের মুখ বন্ধ করে দেবে। সারা রাত ঘুমাননি আনোয়ার। তিনি সকালে নিজে থেকেই থানায় হাজির হন। পুলিশ কর্মকর্তাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে পাশের হোটেলে যান নাস্তা করতে। সেখানে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে বলেন, ‘এসব নিয়ে নতুন করে ঘাঁটাঘাঁটির কিছু নেই। এখানে কিছু টাকা আছে। রেখে দেন। বাদ দিন এসব।’ একথা শুনে পুলিশ কর্মকর্তা তার হাত চেপে ধরেন। বলেন, ‘আপনাকে গ্রেফতার করব। না হয় সব খুলে বলেন।’

আস্তে আস্তে খুলে বলতে থাকেন আনোয়ার স্যার। তার বক্তব্যের ঘটনাটি ছিল এমন, তাকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে এসেছেন সম্পর্কের মামা ফজলুল হক। ফজলুল হক শিক্ষক। থাকতেন তার বাসায়। ফজলুল হকই একই স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি দেন তাকে। ফজলুল হকের স্ত্রীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য অনেক। ফজলুল হক কার্যত অক্ষম ছিলেন। দাম্পত্য জীবনে তার স্ত্রী আশা ছিলেন অসুখী। তাদের মধ্যে একটা শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফজলুল হক যখন স্কুলে চলে যেতেন, বাচ্চারাও থাকত স্কুলে। ওই সময়েই তাদের এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্কুলে চাকরি নেওয়ার পর আনোয়ারের ক্লাস থাকত সকালের দিকে। বেলা ১১টার পর থেকে অলস সময় কাটায়। আনোয়ার বেলা ১১টায় বাসায় চলে আসত। দুই বাচ্চা স্কুল থেকে আসার আগ পর্যন্ত এক সঙ্গে সময় কাটাত প্রতিদিন। স্কুল থেকে ৩টায় বাচ্চারা বাসায় ফিরত। একদিন দুই সন্তান একটু আগেই বাসায় ফিরে আসে। দরজাটা অসাবধানবসত লাগানো হয়। দুই সন্তান ঘরে ঢুকেই তাদের মা এবং আনোয়ারকে এক সঙ্গে দেখতে পান। তখন এক ছেলে বলে উঠে, মা এগুলো কী হচ্ছে। এ কথা শুনেই মা সেই ছেলের মুখ চেপে ধরে। লেপ মুখের ওপর চেপে ধরে। সন্তানের শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। এরপর আরেক ভাই তা দেখে ফেললে আনোয়ার একই কায়দায় তাকেও হত্যা করে। এরপর আনোয়ার তার প্রেমিকা আশার হাত পা বেঁধে মুখে কাপড় গুঁজে দ্রুত ওই বাসা ত্যাগ করে। এরপরই আশা ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করতে থাকে। আশপাশের লোকজন ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। তাকে উদ্ধার করে। এ সময় আশা খাটের কাছে একটি কাগজ দেখতে পায়। সেই কাগজটি আনোয়ারের পকেট থেকে পড়েছিল। আশা সেই কাগজটি প্রমাণ হিসেবে থাকতে পারে বলে ভয় পায়। সেটি কোথায় ফেলবে বা পরে আনোয়ারকে দিয়ে দেবে বলে চিন্তা করে। দ্রুত টয়লেটে যেয়ে ওই প্রশ্নটি টিনের চালের মধ্যে গেঁথে রাখে। খুনের বড় সূত্র হিসেবে কাজে দেয় পুলিশ কর্মকর্তাকে। পুরো ঘটনা শুনে গ্রেফতার করে আনোয়ারকে। গ্রেফতার হয় তার প্রেমিকা সন্তান হন্তারক আশাকে।

No comments:

Post a Comment

মা কে মনে পড়ে লেখা সামিরা আক্তার জেবিন

মাগো তুমি কেমন আছো? আমার ছোট্ট গায়, দূর শহরে থেকো মাগো তোমার সোহাগ চায়। . তুমি পাশে থাকলে মাগো লাগতে দিতে না ব্যথা, এই শহরে থেকে এখন মনে পড়ে...