adsera ad

Saturday, July 18, 2020

প্রেমের গল্প ,একটি শারীরিক মিলনের গল্প

প্রেমের গল্প ,একটি শারীরিক মিলনের গল্প
ঘরে হালকা নীল আলো। অনেকে এসেছিল। সবাই চলে গেছে। এখন কেউ নেই। দোতলার এই ঘরের দক্ষিণ দিকে জানলাটা খোলা। আর জানলার ওপারে দীর্ঘ ছাদ। ছাদের রেলিং এর পাশে গোটা ছাদ বরাবর কংক্রিটের বেঞ্চ মতন করা। সেই বেঞ্চে নানারকম গাছের টব। অগুন্তি। যতীনবাবুর বড় গাছের শখ। গাছগুলোকে সন্তান স্নেহে পরিচর্যা করেন তিনি। যতীনবাবু, অপুর বাবা। অপুকে রাগাতে তার বাবাকে মাঝে মাঝে এই নামেই ডাকতো অভি। অপুকে রাগাতে যে ভীষণ ভালো লাগে অভির!

ঘরে ঢুকে ঘরের প্রবেশ দরজাটা বন্ধ করে পায়ে পায়ে দক্ষিণের এই জানলার কাছে এসে দাঁড়ায় অভি। এক মনোরম সৌরভ বাতাসে ভেসে এসে চারদিক মাতাল করে দিচ্ছে। অথচ অভি ঠিক বুঝতে পারেনা এই স্বর্গীয় সুবাস ঠিক কোন ফুলের। ছাদের প্রতিটা কোণ ভেসে যাচ্ছে মায়াবী জ্যোৎস্নার মৃদু আলোয়।

কে যেন মিউজিক প্লেয়ারে সানাইটা চালিয়ে দিয়ে গেছে। আলি আহমেদ হুসেন। দরবারী কানাড়া। সানাইয়ের সুর কারো বুকে কখনো কান্না ঝরিয়েছে কোনোদিন? অনেকেই জানেনা? অভি জানে। এই বাজনা ও বহুবার শুনেছে। এই সিডি টা যে অভিই উপহার দিয়েছিল অপুকে। পাঁচ দশ মিনিট নয়, পুরো তিরিশ মিনিটের রেকর্ডিং জুড়েই আছে ওই দরবারী।

জানলার গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল অভি। এই স্বর্গীয় পরিবেশ তরল মনকে আরো যেন বাষ্পাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে! না তাকিয়েও বুঝতে পারে অভি যে ঘরে ঢোকার পর থেকেই একজোড়া কাতর চোখ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাকে চাইছে, দুহাত বাড়িয়ে তার বুকে মিশে যেতে চাইছে। সেও তো অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উথলে ওঠা আবেগ নিয়ে তার প্রেয়সীকে তার বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। অথচ ভয় লাগছে অভির। লুকাতে চাইছে সে। নিজের থেকে, তার অপর্ণার কাছ থেকেও। সে জানে ওই কাতর বালিকাসুলভ চাহনীর সামনে সে হেরে যাবে, তার মনের সব কাঠিন্য হেরে যাবে। নিজেকে হারিয়ে ফেলবে সে। তাই তো জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল অভি। তাকিয়েছিল, আর নিজেকে প্রস্তুত করছিল। নিজের উথলে ওঠা কান্নাকে সামাল দিচ্ছিল আর নিজেই নিজেকে বলছিল, ‘আমায় ভেঙে পড়লে চলবে না, কিছুতেই না। আমাকে শক্ত থাকতেই হবে।’

-‘কিগো, দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমার কাছে এসো।’ অপর্ণার গলার শব্দে সম্বিৎ ফেরে অভির। মুখ ঘুরিয়েই দেখতে পায় যে হাতের উপর ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করছে অপর্ণা। প্রায় ছুটে খাটের কাছে চলে এসে নিজের ডান হাতটা অপর্ণার পিঠের নীচে বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেলে অভি।

–‘উঠছ কেন অপু? আমি তো তোমার কাছেই আছি। তুমি শোও, আমি বসছি তোমার পাশে।’

অদ্ভূত শান্ত ভাবে মৃদু হেসে উঠল অপর্ণা। আরো শান্ত স্বরে বলে উঠল, ‘আজ আমি একটু বসি? আজ জানো আমি বেশ ভালো আছি। আজ আমার কোন কষ্ট হচ্ছেনা, বিশ্বাস করো। আজ তুমি যে এসেছো আমার কাছে। এখন আমি প্রাণ ভরে দেখবো তোমায়। সকাল থেকে তোমাকে কত্তবার এইভাবে চেয়েছি, পাইনি। কতদিন পর দেখলাম বলতো তোমাকে?’

-‘তিন মাস এগারো দিন পর।’ আলতোভাবে বলল অভি।

শুনে আবারো সেই মায়া ভরানো হাসি হাসল অপর্ণা। নিজের ডান হাতটা অভির গালে আলতো ছুঁইয়ে বলল, ‘আসতে তোমার খুব কষ্ট হয়েছে তাই নাগো? ট্রেনে রিসার্ভেশন পেয়েছিলে? তোমায় কত কষ্ট দিলাম বলতো?’

কথাগুলো শোনে অভি আর একটা অব্যক্ত অনুভূতি গালের পাশ দিয়ে মস্তিস্ক পর্যন্ত বয়ে যায়।

‘কিছুতেই হেরে গেলে চলবে না, কিছুতেই না’, মনকে প্রবোধ দেয় সে। মুখে বলে, ‘না না, আমার চাঁদের কাছে আসতে আমার কি কষ্ট?’

অপর্ণার হাতটাকে তার গালের সাথে লাগিয়েই আলতো করে ধরে অভি। তারপর সেই হাতে পরম মমতায় ঠোঁট ছোঁওয়ায়। কোনো কথা হয়না। বাতাসে দরবারী কানাড়ার সুর ভেসে চলে। মায়াবী আলোয় দুটি হৃদয় তাদের মনের কথা বলে চলে নিশ্চুপে।

অনেকক্ষণ পর অভি এই পুরনো দিনের খাটের নকশা করা উঁচু মাথার দিকে হেলান দিয়ে বসে অপর্ণাকে আরো কাছে টেনে নেয়। প্রবল শীতে সন্তান যেমন তার মায়ের বুকের উষ্ণতাকে আর বেশি করে পাবার আশায় তার বুকে আরো ঘন হয়ে আসে, তেমনি অপর্ণা অভির বুকে মুখ গুঁজে দেয় পরম মমতায়। গভীরভাবে কান পাতে তার বুকে। কিঞ্চিৎ অস্বাচ্ছন্দ বোধ করে অভি।

বুঝতে পারে অপর্ণা। অভিকে আরো আঁকড়ে ধরে, তার বুক থেকে মাথা না তুলেই বলে ওঠে, ‘তুমি আমার কাছে বোসো, আরো কাছে টেনে নাও আমায়। আমি শ্রেয়াকে বলেছি, কেউ আসবে না এখন, কাউকে আসতে দেবে না ও। তুমি আমাকে আরো কাছে টেনে নাও। তোমার বুকের ভিতরে নিয়ে যাও আমায়। এতদিন তো এই বুকে মাথা রেখেছি, আজকে আমার এই বুকের আরো ভিতরে নিয়ে যাও প্লিজ।’

অনেক কষ্টে নিজের কাঠিন্যকে ধরে রাখে অভি। অপর্ণার চুলের গন্ধ প্রাণ ভরে নিয়ে তার এলোমেলো চুলে আলতো করে বিলি কেটে দিতে থাকে নিজের আঙুল দিয়ে। তারপর গাঢ় স্বরে বলে, ‘তুমি তো আমার বুকের মাঝেই আছো, বোঝোনা তুমি? আমার বুকের শব্দ শুনতে পাচ্ছোনা তুমি, চাঁদ?

-‘পাচ্ছি গো।’

-‘ভালো করে শুনতে পাচ্ছো? বোধহয় পাচ্ছো না। আরো ভালো করে শোনো’। অপর্ণার মাথাকে একটু জোর করে নিজের বুকের বাম দিকে মিশিয়ে নেয় অভি।

-‘পাচ্ছি গো, শুনতে পাচ্ছি। খুব ভালো করে শুনতে পাচ্ছি’।

-‘কি বলছে সে?’

-‘সত্যি কথা বলবো?’ আলতো একটু হাসে অপর্ণা। সেই হাসিতে কিছুটা দুষ্টুমি।

-‘তুমি মিথ্যা বলতে জানোনা অপু। আমি জানি। বলো, কি শুনতে পাচ্ছো?’

-‘বলবো না’। নিজের মাথাকে অভির বাঁধন থেকে খুব সামান্য শিথিল করে বলে ওঠে অপর্ণা।

-‘কেন বলবে না?’ খুব অসহায় বোধ করে অভি। এই সেই নারী যে একদিন তার ছন্নছাড়া জীবনটাকে তার ভালবাসা দিয়ে মসৃণ করে তুলেছিল, পাথুরে জমিতে ভালবাসার মমতা ঢেলে ফুল ফুটিয়েছিল! এইই সেই নারী যার কাছে আসলেই তাই অভি ভুলে যায় যত শোক, দুঃখ, হতাশা, গ্লানি, পৃথিবীর সব লাঞ্ছনা, অপমান, না পাওয়া, সবকিছু। সেই-ই অপর্ণা তাকে চিনতে পারছেনা!

-‘বলবো না, কারণ, আমার অভিকে এখন আমি এইভাবেই পেতে চাই। আমি চাইনা আমি এমন কিছু বলি যাতে তোমাকে এমন করে পাবার সুখে বিন্দু মাত্র আঘাত লাগে’।

-‘আমার বুকে কি শুনছো এটা বললে আমাকে পাবার সুখ নষ্ট হবে!’ ভুল বুঝলো অভি। তাই আবারো বলে উঠল, ‘এই তুমি আমাকে চেনো, এই তুমি আমাকে ভালবাসো?’

কিছুটা অসহিষ্ণু সে। তার কথাতে কি এমন কিছু ধরা পড়েছে যার জন্য তার অপু কষ্ট পেয়েছে, আত্মগ্লনিতে ভুগছে?

-‘তোমায় যে এমন করেই চিনি গো। এমন করেই ভালবাসি। তাই তো এমন করে আঁকড়ে ধরতে চাই। তোমায় না দেখতে পেয়ে আমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম যে। কিন্তু দেখো, আজ তুমি এলে, আজ আমি কত্ত ভালো’।

-‘তবে? বল কি শুনলে, কি বুঝলে চাঁদ?’ কাতর অনুনয় করে অভি। সে যে দ্বিধান্বিত। সে তার অপুকে শেষ ক্ষমতা দিয়ে সুখে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।

-‘সত্যি বলবো? আমাকে কথা দাও যে তুমি আমাকে এমন করেই জড়িয়ে ধরে রাখবে। আবার উঠে ওই জানলার ধারে চলে যাবে না?’

-‘তোমায় ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না, কোত্থাও না’।

একটু শ্বাস নেয় অপর্ণা। অভির জামার বুকের কাছের বোতামগুলো আস্তে আস্তে খুলে দেয় সে। মাথাটাকে অভির শরীরের সাথে আরো মিশিয়ে ডান হাতে তার বুকে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

-‘থামলে কেন অপু, বল?’

-‘তুমি কাঁদছো অভি’। বুক থেকে মাথা না তুলেই খুব ধীরে বলে ওঠে অপর্ণা।

কেঁপে ওঠে অভি। অপর্ণার এই একটা কথাই তার অনেক কষ্টে ধরে রাখা সংযমী কাঠিন্যকে এক নিমেষে ভেঙে খানখান করে দিয়ে যায়। সবকিছু ভুলে যায় অভি। ভুলে যায় অপর্ণা গভীর অসুস্থ। দুহাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে জড়িয়ে ধরে তার অপর্ণাকে, মিশে যেতে চায় তার শরীরের সাথে। দুটো একাত্ম শরীর নীরবে কেঁদে চলে দরবারীর সুরের সাথে মিশে।

*****

অন্ধ্রপ্রদেশ লাগোয়া ওড়িষার সীমান্তবর্তী রায়গড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে তার কোম্পানীর এক প্রজেক্টের কাজে পোষ্টিং ছিল অভির। মা এবং যতীনবাবুর যুগপৎ ফোন পেয়েই তার মনে কু ডেকেছিল, নিশ্চয়ই কোন খারাপ কিছু হয়েছে। সকালে বাড়িতে পৌঁছেই মায়ের কাছে প্রথম শোনে অপর্ণার কথা। তার মারণব্যাধির কথা। যতীনবাবুও অভির আসার খবর শুনেই এ বাড়িতে চলে এসেছিলেন। মা, যতীনবাবু, বেলামাসি এমনকি গণেশদা’ সক্কলেই এই আশঙ্কাই করেছিলেন যে অভিকে সামলানো যাবেনা। তার পরম ভালবাসার অপুর আয়ু যে আর বেশীদিন নেই এই কথা শুনে সে শোকে পাগল হয়ে যাবে।

এই আশঙ্কায় শঙ্কিত ছিলেন ওরা। তাই খুব আস্তে, কিছুটা দ্বন্দ্ব নিয়েই অভিকে জানিয়েছিলেন মা। ছেলের এই ভালবাসার পাত্রীটিকে তিনিও যে নিজের সন্তানের অধিক ভালবেসে ফেলেছিলেন। অপুও তার মেয়ের অভাব তার ভালবাসা, তার নরম কোমল স্বভাব, তার মায়ের প্রতি প্রকৃত টান দিয়ে পূরণ করে দিয়েছিল যে। অপুও যে কোন ছেলেবেলায় তার মা’কে হারিয়েছে। অভির বাবার অপঘাতে মৃত্যু হবার পরে এই সংসারে যে শূন্যতা নেমে এসেছিল, যে ক্ষত নেমে এসেছিল, তা যে এই মেয়েটিই অনেকটা ভরাট করে দিয়েছিল। চাকরি সূত্রে অভি বাইরে থাকে, কিন্তু একদিনের জন্যেও অপু ছেলে কাছে না থাকার এই অভাব অনুভব করতে দেয়নি তাকে। আনুষ্ঠানিক বিয়ে হওয়াটাই শুধু বাকি ছিল, সকলের মনে কবে এই বাড়ির বৌ হয়ে গিয়েছিল অপর্ণা।

সেই কন্যাসমা ফুটফুটে, কোমল স্বভাবের আর মায়াভরা মুখের মেয়েটির মারণ ব্যাধির কথা বলতে বলতে নিজে তিনি বারবার চোখ মুছেছেন, কিন্তু অভি কাঁদেনি একবারও। সব কিছু শান্তভাবে শোনার পর কঠিন মুখে শুধু বলেছিল, ‘এ হতে পারে না মা। আমি এই জীবনে এত পাপ করিনি যে অপু আমাকে ছেড়ে চলে যাবে’।

এক ছুটে অপুর বাড়ি চলে এসেছিল অভি, যতীনবাবুকে সাথে নিয়েই। তন্নতন্ন করে খুঁটিয়ে দেখেছিল অপুর ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশনগুলো, প্যাথলজিক্যাল এবং রেডিওলজির রিপোর্ট। ডাক্তারের ছেলে সে। বাবার চরম ব্যস্ত পেশাগত জীবন এবং তার ফলে পরিবারের জন্য সময়ের অভাব, তার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ব্যক্তিগত জীবনে একাকীত্বের ঘটনা সম্যক প্রত্যক্ষ করেছিল অভি। এই পেশার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে জয়েন্টে চান্স পেয়েও ডাক্তারি সে পড়েনি কিন্তু ডাক্তারীর পরিভাষা তার অজানা নয়। সে সমস্ত কাগজগুলো খুঁটিয়ে দেখছিল আর খুঁজে বেড়াচ্ছিল আশার আলো।

সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে সে তক্ষুনি চলে এসেছিল শহরের প্রখ্যাত অঙ্কোলজিস্ট ডাক্তার অলোক ব্যানার্জির কাছে। ডাক্তার ব্যানার্জি তার বাবার গুটিকয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন। ডাক্তার ব্যানার্জি সব রিপোর্ট ভালোমত দেখে অভিকে নিরাশ করেননি, আবার তীব্র আশ্বাসবাণীও শোনাননি। অভি তবুও শুধু আশাটুকুই নিয়ে চলছিল।

সে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না যে তার অপর্না তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। মন আশা নিরাশার দোলায় দুলছে। তবুও প্রবল কাঠিন্যে মনকে শক্ত করে চলেছে যে, ‘অপর্ণা তাকে ছেড়ে চলে যাবে? এ কি করে সম্ভব? সে কিছুতেই তার অপর্ণাকে যেতে দেবেনা’। ভালবাসার মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসলে বোধহয় মানুষ এরকম ভয়ানক রকমের একবগগা হয়ে যায়। সে একবগগা মন নিয়ে সে ফিরে এসেছে আর চোয়াল শক্ত করে নিজেকেই বলেছে, ‘আমাকে শক্ত হতে হবে, এর শেষ দেখে ছাড়বো আমি, অপু থাকবে না! এ আমি কিছুতেই হতে দেবোনা’।

*****

সেই কাঠিন্যই ধরে রেখেছিল সে এতক্ষণ। অপর্ণার ওই অমলিন ছোট্ট কথাটাই যেন তার প্রতিজ্ঞার বাঁধে ফাটল ধরিয়ে দিল। ভয় পাইয়ে দিল। ‘অপর্ণা নেই’ এই বোধটা কেমন হতে পারে বুঝতে চায়নি সে। বুঝতে দেয়নি মনকে। আর সেই অপর্ণাকেই নিজের বুকের সাথে লেপটে নিয়ে, তার নিশ্বাসের ওঠানামাকে নিজের শরীর দিয়ে অনুভব করতে করতে অভি যখন আবার ভাবল, ‘অপর্ণা নেই’, নিজের শরীর কেমন যেন ভারহীন হয়ে গেল। হেমন্তের বাতাস যেমন প্রকৃতিতে এক বুকচাপা শূন্যতা ছড়িয়ে দিয়ে যায় তেমনি কোথা থেকে বিষাদের এক মন হু হু করা বাতাস ভেসে এসে যেন হৃদয়ের গভীরতম স্থানে এক ভারহীন শুন্যতা ছড়িয়ে দিয়ে গেল। নৈর্ব্যক্তিক এক যন্ত্রণায় কেঁদে উঠল মন। আর সেই যন্ত্রণা বাস্তবিকই অভির চোখের জল হয়ে টুপ করে ঝরে পড়ল অপর্ণার গালে।

অপর্ণা পরম আদরে অভির চোখ থেকে সেই নোনতা জল শুষে নিল নিজের ম্লান ঠোঁট দিয়ে। সেই অপার মমতা মাখা ঠোঁট ছুঁয়ে গেল অভির চোখ, কপাল, গাল, ঠোঁট সব জায়গায়। অভির যন্ত্রণার স্পর্শে অপর্ণার ম্লান ঠোঁটও আস্তে আস্তে রঙিন হয়ে উঠল, উষ্ণ হয়ে উঠল। অপর্ণা আজ কিছুতেই তার অভিকে কাঁদতে দেবে না। তাই যতই তার চোখ বাঁধ না মানুক। অপর্ণা আকন্ঠ পান করল তার মনের মানুষের চোখের জল। সময় বয়ে গেল। অভি আবার চমকে উঠল ওই মাতাল করে দেওয়া আদুরে গলার স্বরে।

-‘আজ আমায় একটু আদর করবে সোনা?’

এই পাগল মেয়ে বলে কি! চমকে উঠল অভি! তেমনি অবাক হওয়া বিস্ময় নিয়ে অস্ফুটে বলে উঠল, ‘এ তুমি কি বলছ অপর্ণা?!’

অপর্ণা একটুও চমকাল না, বরং অভির বলা কোন কথাই সে শুনতে পায়নি এমনভাবে ওর ঠোঁট ছুঁয়ে যেতে থাকল তার ভালবাসার মানুষকে, তার শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে। আর হাল্কা স্বরে বলে যেতে থাকল অনেক কথা, নিজের মনে, যেন নিজের সাথেই কথা বলছে এমনভাবে।

-‘সেদিন খুব কেঁদেছিলাম জানো! তোমায় ছেড়ে চলে যেতে হবে এই কথা আমি কি করে বিশ্বাস করি বল? মনে মনে ঠাকুরকে বললাম, কি এমন দোষ করেছি আমি যে আমায় এমন রোগ দিলে তুমি? তুমি কি জানোনা, কত স্বপ্ন দেখিয়েছি আমি আমার অভিকে? আমাদের বিয়ে হবে, সংসার হবে, সবাই আমাদের দেখে বলবে, দ্যাখ দ্যাখ বরবউকে কি দারুণ মানিয়েছে! আমার অভি আমাকে একটুও কষ্ট দিতে পারেনা। আমার একটু কষ্টও ও সহ্য করতে পারেনা।

নতুন জুতো পরে পায়ে ফোস্কা পড়লে পর্যন্ত ও আমাকে কোলে তুলে নিতে চায়। আমার অভি খুব ভালো। ওর মত মন হয়না। বাবা চলে যাবার পর ও আমার ছাড়া কারো কথা শোনে না। ওর ছন্নছাড়া জীবন কে যে ওর অপুই সাজিয়ে গুছিয়ে তুলেছে। আমিই যে ওকে বাঁচতে শিখিয়েছি আবার। সেই আমিই যদি চলে যাই আমার অভি পাগল হয়ে যাবে। এমন কোরোনা ঠাকুর, আমায় পঙ্গু করে দাও, আমি সইব, কিন্তু আমাকে তুলে নিওনা, আমায় ছাড়া আমার অভি যে মরে যাবে ঠাকুর’।

হাঁফিয়ে উঠেছিল অপর্ণা। একটানা এত কথা বলে। থামল একটু সে। একটু শ্বাস নিল। টেনে টেনে। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘ঠাকুর আমার কথা শুনল না জানো। প্রতিদিনই বুঝতে পারছি, শেষ হয়ে আসছি আমি, একটু একটু করে’।

সহ্য করতে পারলনা অভি। যেন আর্তনাদ করে উঠল সে। বলল, ‘ওরকম করে বোলোনা চাঁদ, আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনবই। তুমি না থাকলে আমি কি নিয়ে থাকবো? কাকে রাগাবো? কে আমার সব খারাপগুলো তোমার মত ভালবাসায় ঢেকে দেবে, কে আমাকে আমার পাগলিটার মত ভালবাসবে? আমি কিছুতেই যেতে দেবোনা তোমায়। এই দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখবো। দেখি তো কে নিয়ে যায় তোমায় আমার কাছ’ থেকে!’

আবারো হাসল অপর্ণা। এমন সেই হাসির অর্থ যেন সত্যি সত্যি সে তার যাবার ডাক শুনে ফেলেছে। অভি’র কথার উপর কোন কথা বলল না সে। একটু থামল। আবার বলে উঠল, ‘অনেকদিন আগে তোমায় একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে সোনা?’

-‘কি কথা চাঁদ?’

-‘তখন এমনিই বলেছিলাম হয়ত, না বুঝে। আজ সত্যিই বলছি। তাই আমার যে সম্পদ তোমাকেই উৎসর্গ করবো বলে সামলে রেখে দিয়েছিলাম তা আমি তোমাকে দিয়ে যেতে চাই। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না।

-‘তোমার কি সম্পদ অপু?’

-‘আমাকে তুমি গ্রহণ কর’।

-‘কী বলছ কি তুমি অপু! আমি কি পশু? অমানুষ?!’ আঁতকে উঠে বলে অভি।

-‘তোমাকে আমি আমার দেবতার স্থানে বসিয়েছি অভি। তাই তো আমার যা কিছু সব আমি তোমাকে দিয়ে যেতে চাই। সেদিন বলেছিলাম না, যা কিছু আমার তার সবটুকু তোমাকে উৎসর্গ না করে আমি মরেও শান্তি পাবোনা- আজ আমাকে আমার কথা রাখতে দাও সোনা। আমাকে প্রমাণ করতে দাও যে আমি আমার অভিকে কথার কথা বলিনি’।

এই বলে একটু থামে অপর্ণা। শ্বাস নেয়, আবার বলে, ‘আমাকে ফিরিও না অভি, আমার ভালবাসা কে পূর্ণ করে দাও। যেন মরেও আমি কষ্ট পাই এই ভেবে যে আমার অভিকে আমি অপূর্ণ রেখে এসেছি। তোমার আদরে আমাকে ভরিয়ে দাও সোনা, পূর্ণ করে দাও আমায়। কোথায় যাবো জানিনা তো, যাবার আগে তোমার আদরগুলোকে সম্পূর্ণ করে সঙ্গে নিয়ে যাই’।

অনেকক্ষণ অপর্ণাকে বুকের সাথে জাপটে ধরে নিজের কান্নাগুলোকে লুকাচ্ছিল অভি। আদরমাখা প্রেয়সীর ওই কথাগুলো বৃষ্টির শব্দের মত বাজছে। মনটা পুলকিত হয়ে উঠছে এই ভেবে যে, এরকম ভাবে কেউ ভালবাসে তাকে, এইরকম ভাবে চায়?! মনের মানুষ কোন নারী কোন পুরুষকে এইভাবে চাইলে তার তো নিজেকে পৃথিবীর সম্রাট বলে মনে হওয়া উচিত! মনে হচ্ছেও তাই অভির। পরক্ষণেই বাঁধ ভাঙা বন্যায় ভেসে যাচ্ছে মন, যেই ভাবছে তার রাণী নেই, একলা ফেলে চলে যাবে তাকে!

কাতর চোখে তার সেই মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে থাকে অপর্ণা। সেই চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মুখ নামিয়ে তার অপুর ঠোঁটে ঠোঁট রাখে অভি। পিপাসার্তের মত আকণ্ঠ পান করে তার না হওয়া স্ত্রী কে। অলীক আনন্দে কেঁপে ওঠে অপর্ণা। অভিকে সঙ্গ দেয় সে। অসুস্থ শরীর ক্লান্ত হয়ে ওঠে, তবুও সে ছাড়েনা তাকে। হাজার জন্মের জমে থাকা পিপাসা নিয়ে সে পান করে তার প্রেমিককে।

কত ক্ষণ বয়ে গেছে হিসাব থাকেনা। আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে খুব সন্তর্পনে অপর্ণাকে মাটিতে দাঁড় করায় অভি। কিছু বোঝার আগেই নীচু হয়ে তার চাঁদকে কোলে তুলে নেয়। মুখ রাখে তার স্তনসন্ধিতে। এতদিন কাছাকাছি থেকেছে তারা, কাটিয়েছে অসংখ্য নিভৃত মুহূর্ত। কিন্তু আজ অবধি কোনদিন অভি অপর্ণার স্তন স্পর্শ করেনি, মনেই আসেনি সেই কথা। ভাবতো, কিছু ঐশ্বর্য এতো অমুল্য হয় যে অধিকার আছে বলেই তাকে হেলাফেলা করে ব্যবহার করতে হয়না। কিন্তু আজ এই বিষাদ মাখা মিলন মুহূর্তে অন্তর্বাসহীন তার প্রেয়সীর নরম বুকের গভীরতায় যে কান্নামাখা যন্ত্রণাগুলো লুকিয়ে ছিল তাকে এক লহমায় ধুয়ে মুছে দিতে চাইল অভি।

অপর্ণা বিস্রস্ত। তার হাউসকোটের বন্ধনী খুলে গেছে। তার রোগাক্রান্ত শরীর পরতে পরতে খুলে যাচ্ছে। আর খুলতে খুলতে জেগে উঠছে। উন্মুক্ত লাজুক স্তনবৃন্তে অভির উত্তপ্ত জিভের স্পর্শ জাগিয়ে তোলে অপর্ণাকে। প্রবল শীৎকারে সে অভিকে সজোরে আঁকড়ে ধরে। মুখ তুলে হালকা করে কানের লতিতে দাঁত বসায় অভির। এইভাবে দুটো শরীর পরস্পরকে পূর্ণতা দেওয়ার খেলায় মেতে ওঠে।

নিজের অপাপবিদ্ধ শরীরে তার মনের মানুষকে গ্রহণ করতে করতে অপর্ণা ডুকরে কেঁদে ওঠে। নিজের সমস্ত ঔদ্ধত্য তার প্রেয়সীকে দান করতে করতে অভিও কাঁদতে থাকে। চরম উত্তেজনায় দুটি শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। মিলন সুখ যত কাছাকাছি আসে তত হাহাকারে ভরে ওঠে মন। পরম আশ্রয়ের খোঁজে দুজনেই দু’জনের শরীরে স্থান খোঁজে। দুটো শরীর এক হ’তে হ’তে, এক হ’তে হ’তে ঝর্ণা হয়ে ঝরে পড়ে।

সেই ঝর্ণায় ভিজতে ভিজতে শরীরের মাঝে বর্ষা নামে, চোখে বর্ষা নামে। আর সেই বন্যার বাঁধভাঙা জলের উচ্ছ্বাসে হৃদয় দুটি বন্যার্ত হয়।

শরীর, মনের এই ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে, বৃষ্টিতে ভিজে শিরশির কাঁপতে কাঁপতে অপর্ণা সবলে অভি’কে আঁকড়ে ধরে।

-‘আমাকে আরও শক্ত করে ধরে রাখো সোনা, আমাকে তোমার কাছ থেকে কাউকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে দিওনা। আমার সব ভয় দূর করে দাও তুমি’।

-‘কেউ তোমাকে আমার থেকে নিয়ে যেতে পারবে না’, প্রাণপনে অপর্ণাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে অভি।

-‘আমি তোমায় ছেড়ে যেতে চাইনা গো, কিছুতেই তোমায় ছেড়ে যাবোনা আমি। যাবোনা, যাবোনা, কিছুতেই যাবোনা’। কাঁদে আর বলে, বলে আর কাঁদে।

তারপর হঠাৎ বৃষ্টি থামে। নির্মল আকাশে পৃথিবী শান্ত হয়। দক্ষিণমুখী জানলা দিয়ে হাস্নুহানা সুবাস ভেসে আসে। অপার্থিব জ্যোৎস্নায় পৃথিবী আবার মায়াবী হয়ে ওঠে।

ছাদের দিকে মুখ করে শুয়ে অপর্ণার মাথাকে নিজের বুকের উপর রাখে অভি। তার অপুর এলোমেলো কেশরাশির মাঝে নিজের আঙুল দিয়ে পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অভি বলে, ‘তুমি ঘুমাও চাঁদ। আমি তোমাকে ঘুম পারিয়ে দিচ্ছি’।

দরবারী কানাড়া কবেই শেষ হয়েছে।

*****

অপর্ণা তার শেষ কথাগুলো রাখতে পেরেছিল কি?

অভি হয়েও আমি জানি না গো। সত্যিই আমি জানিনা। আমার কাছে জানতে চেওনা তোমরা। প্লিজ।

*** ইতি ***

No comments:

Post a Comment

মা কে মনে পড়ে লেখা সামিরা আক্তার জেবিন

মাগো তুমি কেমন আছো? আমার ছোট্ট গায়, দূর শহরে থেকো মাগো তোমার সোহাগ চায়। . তুমি পাশে থাকলে মাগো লাগতে দিতে না ব্যথা, এই শহরে থেকে এখন মনে পড়ে...